ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী অধ্যাপকের চোখ উপড়ে ফেলা হল, শিশু বাচ্চার সামনে তার উপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হল, ঘটনার পর দিন থানায় মামলা হল... আর সেই খবরটা পত্রিকায় প্রকাশিত হতে আট দিন সময় লাগল! দশ দিন ‘চেষ্টা’ করেও ঘাতক হাসান সাইদকে গ্রেফতার করতে পারলোনা পুলিশ! খবরটা যেই দিন পত্রিকায় ছাপা হলো তার পর দিনই নির্যাতিত রুমানা মনজুরকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হল ‘উন্নত চিকিৎসার’ জন্য ।
বেশি দিন হয়নি কলেজ ছাত্র লিমনের পা খোয়ানোর ঘটনায় দেশের প্রধান দুই দৈনিক --প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার—ডজন ডজন তদন্তমূলক প্রতিবেদন ছেঁপেছে । দিনের পর দিন পত্রিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে ছিল লিমনের পা । এতে পত্রিকা দুটোর জনপ্রিয়তা যেমন বেড়েছে, পাঠকও তেমন বেড়েছে । বেড়েছে বিজ্ঞাপনের দামও । আর সেই প্রথম আলোই একজন অধ্যাপিকা নির্যাতনের এমন নৃশংস ঘটনায় মাত্র দুই কলামের একটা সংবাদ ছেপে শেষ!! তার আবার শিরোনাম দেখলে মনে হবে এটা যেন অজপাড়াগায়ের কোনো নির্যাতিত নারীর গল্প । ‘পারিবারিক নির্যাতনের ভয়ংকর রুপ’ শিরোনামের ঐ সংবাদ ছাপানোর পর দিন অর্থাৎ ১৫ তারিখের প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় রুমানাকে নিয়ে আর কোনো সংবাদই নাই!
Somewhereinblog এ পড়েছি নরপশু হাসান সাইদ বন ও পরিবেশ মন্ত্রী হাসান মাহমুদের ভাতিজা । সেই ক্ষমতা ব্যাবহার করেই হাসপাতালে শয্যাশায়ী রুমানাকে গুলী করে অথবা এসিডে ঝলসে হত্যার হুমকিও দিয়ে যাচ্ছিল সে । জানাজানি হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হাসান সাইদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন, সমাবেশ ও মৌন মিছিল করে । হাসানকে গ্রেপ্তারের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি । লাভ হয়নি । কারণ আসামী পলাতক । পুলিশ খুঁজে পাচ্ছিলনা তাকে ।
নাটক শুরু হয় ১৫ই জুন । ঐ দিন সকালে হাসানকে কেন গ্রেপ্তার করা হয়নি তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট । আর তার কয়েক ঘন্টা পরেই হাসান গ্রেফতার! পরদিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে রিমান্ডেও নেয়া হয় । এতেই ছাত্র, শিক্ষক, আদালত--সবাই মোটামুটি ঠান্ডা ।
গ্রেফতার হবার কয়েক ঘন্টা পরেই টেলিভিশনে হাসানের লম্বা বক্তৃতা দেখানো হল । বক্তৃতা দেখেই মনে হচ্ছিল মিডিয়ার সামনে আসার আগে গোয়েন্দাদের কাছ থেকে লম্বা প্রশিক্ষণ নিয়েছে সে । শিখে এসেছে কিভাবে একজন শিক্ষকের নামে অপবাদ দিয়ে ক্ষমতাসীনদের মান আর নিজের জান রক্ষা করা যায় । রুমানা নাকি কার সাথে পরকিয়ায় লিপ্ত ছিলেন! আর হাসান তার বিরোধিতা করায় তাকে হত্যা করার জন্য রুমানা তাকে ১০০ ঘুমের বড়ি খাইয়েছিলেন! এ গল্প পত্রিকাগুলোও বেশ ঘটা করে ছেপেছে । প্রশ্ন হলো ১০০ বড়ি খাওয়ার পরও হাসান বেঁচে ছিলেন এবং শশুর শাশুড়ীকে বেধে রেখে রুমানাকে এভাবে নির্যাতন করার শক্তি ছিল তার গায়ে!! বাংলা সিনেমায়ও এত শক্তিধর নায়ক দেখা যায় না ।
তবে তার গোয়েন্দা প্রশিক্ষণ যে সফল হয়েছে সেটা ঠিক । ১৫ই জুন সন্ধ্যায় অনেককেই বলতে শুনেছি ‘আসল কাহিনি তাহলে এই? লোকটার একার দোষ দিয়ে লাভ কি?’ আরও কত কি!!
২
দু’বছর পুরো হয়নি আমার সহপাঠী সুতপাকে হত্যা করা হয়েছে । সুতপার আসল নাম মাফরুদা হক । হত্যা করার পর ওর শশুর বাড়ির লোকজন একে আত্নহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেও ময়না তদন্তের পরপরই পুলিশ আমাদের জানায় সুতপাকে হত্যা করা হয়েছে ।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ সহ আরো বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী এই ঘটনার প্রতিবাদ করল...ঘাতক ইমরুল সাদাত আবীর এর শাস্তি দাবি করল । ক্যাম্পাসে মানব বন্ধন হলো, সমাবেশ হলো । ঘাতককে গ্রেফতারও করা হলো, রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল । আমরাও বিচার পেয়ে গেছি ভেবে চুপ হয়ে গেলাম । সুতপাকে ভুলে যেতে শুরু করলাম ।
হঠাৎ একদিন শুনলাম সুতপা হত্যা মামলায় চার্জশিট দেয়া হয়েছে । চার্জশিটে বলা হয়েছে সুতপা আত্নহত্যা করেছে । খুনী ইমরুল সাদাত তাহলে নিরপরাধ!!
৩
সুতপা আর রুমানাদের কথা অনেকেই জানেন কারণ ওরা এ দেশের সর্ববৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী...শিক্ষক । ওদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদ হয় । নির্যাতন কারীরা গ্রেফতার হয় । রিমান্ডে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ হয় । জিজ্ঞাসাবাদকালে তারা অপরাধের কথা স্বীকার করে এবং......পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে ছাড়াও পেয়ে যায় ।
কিন্ত প্রতিদিন দেশের আনাচে কানাচে যত নারী নির্যাতিত হয়, যত মানুষ খুন হয় তার কত শতাংশ খবরের কাগজে ছাপা হয়? কয়টা ঘটনার প্রতিবাদ হয়? কয়টা ঘটনায় মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিবৃতি দেয়? কয়জন অপরাধী গ্রেফতার হয়? আর বিচার? সেতো সুতপা রুমানারাই পান না যাদের জন্য শিক্ষক শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমে আন্দোলন করেন, বুদ্ধিজীবিরা পত্রিকায় কলাম লিখেন, মন্ত্রী এমপিরা দুঃখ প্রকাশ করেন এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিবৃতি দেয় ।
এমন কোনো সপ্তাহ নাই যে সপ্তাহে দু’এক হালি হত্যাকান্ডের খবর পত্রিকায় আসেনা । কোনো ঘটনার সঠিক তদন্ত হয়েছে, কোনো অপরাধীর বিচার হয়েছে তা খুব একটা শোনা যায় না । দূর্ণীতি, লুট পাট, জমি দখল, বাড়ি দখল, খাল দখল, বিল দখল, নদী দখল, সরকারি প্রকল্পের টাকা চুরি, গম চুরি, চাল চুরির খবরতো পত্রিকায় অপরাধীদের নাম সহ ছাপা হয় । কোনো ঘটনার বিচার হয়েছে শুনিনি ।
শুনেছি অনেকেই বিচার প্রতিবাদতো দুরের কথা, নির্যাতনের কথা আরেকজনকে বলার সাহস পর্যন্ত পায় না । থানায় গেলে পুলিশ মামলা নেয়না । আর মামলা করার সাহসই বা কয়জনের আছে । সাহস থাকলেও মামলা চালানোর সামর্থ্য কয়জনের আছে? সামর্থ্য থাকলেও মামলা চালিয়েই কি লাভ? মামলার রায় কবে হবে তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? রায় হলেও তা কি আসামীর শাস্তি নিশ্চিত করতে পারে? লিমনের ঘটনায় দেখেছি আদালতের রায়ও তোয়াক্কা করেনা আইনশৃংখলা বাহিনী । আদালতের নির্দেশের পরেও Rab এর বিরুদ্ধে মামলা নেয় নি পুলিশ । গণমাধ্যমের জোর জবরদস্তির ফলেই অবশেষে লিমন কে জামিন দেয়া হয় । জামিনের পরেও তাকে আবার হাসপাতালে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় ।
একজন আইন ব্যাবসায়ী জানালেন দেশের সব নাগরিকের দায়ের করা মামলা চালানোর দায়িত্ব নাকি সরকারের। অর্থাৎ পুলিশ যে মামলা নথিভুক্ত করবে তা পরিচালনা করার দায়িত্ব সরকারের । নিম্ন আদালতের মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পাবলিক প্রসিকিউটরদের আর উচ্চ আদালতের মামলা পরিচালনার দায়িত্ব এটর্নি জেনারেলের অফিসের । দেশের কয়জন নাগরিক এই সেবা পান? পাবেন কি করে? এসব অফিসের কর্মকর্তাদের তো বড় বড় লোকের লুটপাট আর চুরির মামলা ডিফেন্ড করতে করতেই জান শেষ । আর সে জন্যই তো সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে এসব অফিসের ব্যাবসায়ীদের চেহারাও পাল্টে যায় । সরকারি এসব আইন অফিসের একজনকেও কি পাওয়া যাবে যারা ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে যুক্ত নন? যারা কখনো কোনো না কোনো ভাবে লুট পাট আর দখলের ভাগ পান নি?
৪
সাধারণ মানুষদের কথা বাদ । যারা অসাধারণ তারা কি বিচার পান? যেসব ঘটনায় পত্রিকাগুলো মাসের মাসের মাস সংবাদ ছাপে, যেসব ঘটনাকে পুজিঁ করে রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতি করে, হরতাল করে, গাড়ী পোড়ায়, পুলিশের সাথে মারামারি করে সেসব ঘটনার বিচার হয়?
গত পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনার ১০ বছর পুরা হল । ঐ বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হয়েছেন, ১১ জন পঙ্গু হয়েছেন । বিচার হয়নি । কেউ জানেন না আদৌ এর বিচার হবে কিনা । যদিও ঐ ঘটনাকে পুঁজি করে রাজনীতির মঞ্চ কাঁপিয়েছেন অনেকেই । যশোরে উদিচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার বিচার হয়নি । বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যা করা হয়েছে । এমনকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর উপরও গ্রেনেড হামলা হয়েছিল । তারও বিচার হয়নি । শুধু রাজনীতি হয়েছে ।
গত বছরের অক্টোবর মাসে নাটোরের বরাইগ্রাম উপজেলার চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ বাবুকে দিনের আলোতে হাজার হাজার মানুষের সামনে খুন করল ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা । সব পত্রিকায় খুনের ছবি ছাপা হলো । টেলিভিশনগুলো ভিডিও প্রচার করলো । তদন্তকারীরাও নিশ্চিত করে বললো যে যুবলীগের কর্মীরাই বাবুকে হত্যা করেছে । সব কিছুকে উপেক্ষা করে অক্টোবরের ১৪ তারিখে আওয়ামীলীগের ‘আইনপ্রনেতা’ আব্দুল কুদ্দুস খুনীদের আশ্বস্থ করে বললেন দলের কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যাবস্থা নেয়া হবে না । তিনি প্রধান আসামী জাকিরের প্রশংসাও করলেন । এই ঘটনায় ১০ জনকে গ্রেফতার করা হলেও এ বছর মার্চের ১০ তারিখ সবাই জামিনে মুক্ত হয়ে যান । এই নিয়ে পরে আর কিছু শোনা যায় নি ।
২০০৭ সালের ২১ অক্টোবর বিকালে নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলার শরীফপুর গ্রামের আব্দুর রশীদকে লক্ষ্য করে এসিড ছুঁড়ে তারই গ্রামের ভিটু মিয়া ও তার সাঙ্গ পাঙ্গরা । থানায় মামলা হয় । ঐ মামলা চালাতে সহযোগীতা করত এসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন । এমনকি ভিকটিম এবং তার পরিবার যাতে মামলাটি নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যাবস্থা গ্রহন করার জন্য এসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মনিরা রহমান নিজে অপরাধ মামলা মনিটরিং সেল, স্বরাস্ট্র মন্ত্রনালয়কে চিঠি দেন । ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মামলার অভিযোগ পত্রও দাখিল করা হয় । কয়েক মাস আগে মামলাটিকে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা বলে ফেলে দেয়া হয়েছে । হুমকি ধামকির মুখে আব্দুর রশীদ মিডিয়াকে এই ঘটনা জানায়নি ।
৫
ক্ষমতাসীনরা একের পর এক অপরাধ করে যান এবং পারও পেয়ে যান । মজার ব্যাপার হলো তারা নিজেরাও যখন আক্রান্ত হন...সুবিচার পান না । বিরোধীদলের কথা বাদই দিলাম...গত দুই বছরে ক্ষমতাসীন দলের কত লোক নিহত হয়েছে হিসাব নাই । একটারও কি বিচার হয়েছে? রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য আন্তঃকোন্দল, স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে ঝগড়ার সূত্র ধরে একই দলের এক কর্মী খুন করেছে আরেক জনকে । খুনিরা শাস্তি পেয়েছে শুনিনি কখনো । শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক ছাত্র নিহত হয়েছে । কোনো হত্যার বিচার হয়নি । বিচারের আশা করা দুঃসাহসিকতা বৈকি? কয়েক মাস আগেইতো হাইকোর্টে এক বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে আইনজীবিদের ব্যাপক প্রতিবাদ দেখলাম । কারন ঐ বিচারপতি ছাত্র খুনের দায়ে অভিযুক্ত ছিলেন । এমনকি তার নিয়োগের সময়ও ঐ মামলা চলছিল ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু নিশ্চয়ই অন্য মৃত্যুগুলোর মতো নয় । বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের প্রায় সব সদস্য খুন হলেন দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র কয়েক বছরের মাথায় । হত্যাকারীরা গণমাধ্যমে তাদের অপকর্মের কথা স্বীকারও করল । তবুও বিচার হলো না । আমাদের বিচার ব্যাবস্থা হত্যাকারীদের একাংশের শাস্তি নিশ্চিত করতে পেরেছে ৩৮ বছর পর ।
বঙ্গবন্ধু খুন হবার কয়েক মাস পরেই খুন হলেন স্বাধীনতার আরও চার নায়ক । অস্থায়ী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট, স্বরাস্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী খুন হলেন জেল খানায় । জেল খানার কয়েদীদের হত্যা করার ক্ষমতা কাদের রয়েছে তা সবারই জানা । কিন্ত এই চার নেতার হত্যাকারীদের বিচার এখনো হয়নি ।
মুক্তিযুদ্ধের একটা গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের অধিনায়ক এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান খুন হলেন । নামে একটা বিচার হয়েছে তার সমর্থকদের থামিয়ে রাখার জন্য । এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের আরও বহু বীর নিহত হয়েছেন । বিচার হয়নি কোনো হত্যার।
গত কয়েক বছরে মন্ত্রী থেকে শুরু করে তার নিচের পর্যায়ের কত নেতা খুন হয়েছেন । বিচার হয়নি । সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া, আওয়ামী লীগ নেতা আইভি রহমান, আহসানুল্লাহ সহ আরো বিভিন্ন দলের বহু নেতা খুন হয়েছেন । বিচার হয়নি ।
৬
দেশে অপরাধ যত বেশি, পুলিশ আর আইন ব্যাবসায়ীরা তত খুশী । মামলার বিচার হয়না অথচ হাজার হাজার আইন ব্যাবসায়ী কোটিপতি হয়েছেন এই মামলাগুলোকে পুঁজি করে । ডেইলি স্টার পত্রিকার সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১০ এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে পেশাদার আইনজীবিদের সংখ্যা হলো ৪১ হাজার । এদের মধ্যে ৫ হাজার জন নারী আইনজীবি রয়েছেন ।
এই মার্চের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল ২,৩০২ জন । এরাই দেশের সর্বোচ্চ আইনজীবি । নিম্ন আদালতের রায় চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতের রায় পরিবর্তন করেন এরা । তবে সাধারণ মানুষের পক্ষে এদের পোষা সম্ভব না । এক মামলার বাদী জানিয়েছেন একটা রিট পিটিশন দায়ের করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবি তার কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়েছেন । এক লাখ টাকা গচ্ছা দিয়ে ঐ লোক আর কোনোদিন আদালতে আসেন নি । নিজের চিকিৎসা করার পয়সা নাই আইনব্যাবসায়ীরে দিবেন কোথা থেকে? অনেক বিচারপ্রার্থী তাদের সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে এই আইন ব্যাবসায়ীদের ফি পরিশোধ করেন ।
আদালতের খরচও কি কম? আদালতের ফি কতজন মানুষ দিতে সক্ষম? ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৬ তারিখে হাইকোর্টের একটি রুলের কথা মনে পড়ে । বিচারপতি মোঃ ইমান আলী এবং বিচারপতি মোঃ আবু তারিক সরকারের প্রতি একটা রুল জারি করেছিল । ঐ রুলে সরকারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল সরকার যে উচ্চ আদালতের ফি বাড়িয়েছিল তা কেনো অবৈধ ঘোষণা করা হবেনা ।
১৯৮৮ সালের আপিল বিভাগ রুল হালনাগাদ করে আপিল বিভাগের আদালত ফি কয়েকগুন বাড়ানো হয়েছিলো । যেমন আগের নিয়ম অনুযায়ী, যেকোনো মামলার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের সর্বোচ্চ আদালত ফি ছিল ৪,০০০ টাকা । সেটা বাড়িয়ে ১ লাখ করা হয়েছে । ন্যায় বিচার চাইতে গিয়ে আদালত ফি যদি দিতে হয় ১ লাখ টাকা, তাহলে কতজন ন্যায় বিচার চাইতে যাবেন?
হাইকোর্টের এক কর্মকর্তার কাছে শুনেছি আইনজীবিরা চান না কোনো মামলার চুড়ান্ত নিস্পত্তি হয়ে যাক । তারা এমন ভাবে মামলা পরিচালনা করেন যাতে রায় দীর্ঘায়িত হয় । তবে এ জন্য তাদের খুব খাটাখাটি করতে হয় না । এক মামলা একবার স্থগিত করা গেলেই সেটার আবার আদালতের শিডিউল পেতে বছর লেগে যায় ।
২০০৯ সালে যতজন হাইকোর্ট থেকে অন্তর্বতীকালিন জামিন নিয়েছেন, তাদের ৩,২০০ জনই জামিন নেয়ার পর আর কখনোই আদালতে হাজিরা দেননি । তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিবে কে? (ডেইলি স্টার জানুয়ারি ১২, ২০১১)
৭
২০১১ সালের ২০ মার্চ আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ জাতীয় সংসদে বলেছেন দেশের বিভিন্ন আদালতে বর্তমানে ১৯ লাখ ৪২ হাজার ১৮৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে । যার মধ্যে ৯ হাজার ১৪১ টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে আপিল বিভাগে । আর ৩ লাখ ১৩ হাজার ৭ শত ৩৫ টি রয়েছে হাইকোর্টে ।
নয় হাজারের বেশি মামলার বিচারের জন্য আপিল বিভাগে মোট বিচারক রয়েছেন প্রধান বিচারপতি সহ আট জন । আর ৩ লাখ ১৩ হাজার ৭ শত ৩৫ টি মামলার বিচারের জন্য হাইকোর্টে বিচারক রয়েছেন ৯০ জন (সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইট, ১৬ ই এপ্রিল ২০১১) ।
দেশের চলমান বিচার ব্যবস্থায় যে কোনো মামলার চুড়ান্ত নিস্পত্তি হয় আপিল বিভাগের মাধ্যমে । যে কোনো মামলার প্রথম রায় হয় নিম্ন আদালতে । যদি কোনো এক পক্ষের ঐ রায় পছন্দ না হয় তাহলে তারা ঐ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করতে পারেন । দুই পক্ষের শুনানি শেষে হাইকোর্ট আবার রায় দেন । যদি এই রায়ও কোনো এক পক্ষের পছন্দ না হয় তা হলে তারা আপিল বিভাগে আবেদন করতে পারেন । এবং আপিল বিভাগের এই রায়ও চুড়ান্ত রায় নয় । আপিল বিভাগ রায় প্রদান করার পরও কেউ চাইলে ঐ রায় রিভিউ করার আবেদন করতে পারেন । অর্থাৎ ১৬ কোটি মানুষের বিচারের ভার মূলত আটজন বিচারকের উপর ।
কথা হলো এই আটজন মানুষ দৈনিক কয়টি রায় প্রদান করতে পারেন? ছুটি ছাটা বাদ দিয়ে তারা বছরে কয় দিন আর কাজ করতে পারেন । হাইকোর্টের একজন আইনজীবি বলেছেন আপিল বিভাগের বিচারকদের বেশির ভাগ সময় কাটে বড় বড় ঘটনার বিচার কার্যক্রমে । এমনও অনেক সময় যায় যখন টানা কয়েক সপ্তাহেও সুপ্রিমকোর্ট একটি মামলার রায় দিতে পারেন না । যেমন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সময় টানা বহু দিন আপিল বিভাগ আর কোনো মামলার কার্যক্রম চালাতে পারেন নি । একই ভাবে সংবিধান সংশোধন মামলা, স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে মামলা, সংবিধান পূনঃমূদ্রন মামলা, আমার দেশ সম্পাদক এর বিরুদ্ধে মানহানি মামলার শুনানির সময় আদালত আর কোনো মামলার শুনানি হয়নি । মাসে আসলে দু’এক ডজনের বেশি মামলা কোনো ভাবেই নিস্পত্তি সম্ভব নয় । সুতরাং বিচারাধীন ২০ লাখ মামলার বিচার অদৌ সম্ভব নয় ।
২০১০ এর অক্টোবর মাসে হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৫৩ হাজার । প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেয়া বিশেষ পদক্ষেপের ফলে ২০১০ এর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে এই সংখ্যা ৩ লাখ ১৩ হাজারে নেমে আসে । অনেকেই অবাক হতে পারেন এই ভেবে যে তিন মাসে ৪০,০০০ মামলা কিভাবে নিস্পত্তি হলো ! আসলে এই মামলাগুলোর নিস্পত্তি সম্ভব হয় নি । এগুলোর আর বিচার হবেনা । এর আসামীরা পার পেয়ে গেলেন ।
তখনকার প্রধান বিচারপতি দেখলেন সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দিষ্ট সেকশনে ৪০,০০০ মামলা দায়ের হয়েছে যেগুলো কোনো বেঞ্চই শুনেনি । ফলে নভেম্বরে এই মামলাগুলো হাইকোর্টের ‘বিচারাধীন তালিকা’ থেকে ফেলে দেয়া হয়েছে ।
নাম প্রকাশ না করে সুপ্রিম কোর্টের এক কর্মকর্তা বলেছেন বিচারাধীন মামলাগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সময় তারা ৩৯ টি জামিন আবেদন পেয়েছেন যেগুলো ১৯৯৬ সালে দাখিল করা হয়েছিল । ঐ আবেদনগুলো ২০১১ সাল পর্যন্ত শুনা হয়নি ।
তবে আদালতের খরচ আর আইন ব্যাবসায়ীদের ফি দেয়ার ক্ষমতা যার নাই হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্টের ঝামেলাও তার নাই । শুধু চুপচাপ সবকিছু সহ্য করতে পারার ক্ষমতা অর্জন করতে পারলেই হলো । কোনোভাবেই আদালতের সমালোচনা করা যাবে না । আদালত অবমাননা মামলা ভয়ংকর মামলা । এসব মামলার নিস্পত্তি হয় খুব তাড়াতাড়ি ।
৮
ষোল কোটি মানুষের বাংলাদেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষই দিনে দুই বেলা খাবার যোগাড় করতে পারেন না । এসব পরিবারের দৈনিক আয় ৯০ টাকারও কম । প্রতিদিন নানান অন্যায়, অত্যাচার আর অবিচারের শিকার হন এরা । সুবিচারের প্রয়োজন এরাই সবচেয়ে বেশি অনুভব করেন কিন্ত ‘বিচার ব্যবস্থা’ নামক সাদা হাতির ধারে কাছেও তারা পৌছাতে পারেন না । অবশেষে নালিশ করেন আল্লাহর কাছে ।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী বাকি সাড়ে আট কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র আট লাখ মানুষ খেয়ে পড়ে অন্যান্য কাজে টাকা খরচ করার ক্ষমতা রাখেন ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী এই আট লাখ মানুষ প্রতিদিন ৪৫০ টাকার বেশি আয় করেন । বছরে এদের আয় ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকার বেশি । এরা করদাতা, প্রথম শ্রেনীর নাগরিক ।
এছাড়াও আরো ১৪ লাখ মানুষ আছেন যাদের বাৎসরিক আয় মাঝে মাঝে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা অতিক্রম করে । অর্থাৎ এদের ট্যাক্স পরিচয় নাম্বার আছে কিন্ত প্রতি বছর ট্যাক্স দেয়ার মত টাকা আয় করতে পারেন না ।
বাকি আট কোটিরও বেশি মানুষের পরিবারের দৈনিক আয় ৪৫০ টাকার কম । যে টাকা দিয়ে কোনো রকমে থাকা, খাওয়া, পোশাক আশাক, ছোটো খাটো রোগের চিকিৎসা সম্ভব । অন্যায় নির্যাতনের শিকার হলেও বিচারের জন্য ব্যয়বহুল আইনের দোকানে যাওয়ার ক্ষমতা এদের অনেকেরই নাই । ঝগড়া ফাসাদ, কোর্ট কাচারি তাই যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলেন এদের অনেকেই ।
সরকারী হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের যে ২২ লাখ ধনী মানুষ রয়েছেন তারা বিচার ব্যবস্থার সুফলতা কতটা ভোগ করছেন? এই ২২ লাখের একটা বড় অংশ সব সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত থাকেন । বিরোধী দলের জন্য সুবিচার প্রত্যাশা করা ধৃষ্টতা বৈকি । এ ছাড়াও বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর সদস্যরাও বিচার ব্যবস্থার সুফল পান না ।
বাকি থাকে থাকে সরকার দলীয় নেতা কর্মী, আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্য, সরকারী কর্মকর্তা, আইনজীবি এবং বিচারকদের পরিবারের সদস্য এবং ব্যাবসায়ীরা । পুলিশ, সরকারি দফতর এমনকি বিচারকদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাব সুস্পষ্ট । সুতরাং সরকারের বিরাগভাজন কর্মকর্তা কর্মচারীরাও অবিচারের শিকার হন । কিন্ত বিচারের জন্য আদালতে গিয়ে খুব একটা ফল হয় না ।
৯
আমাদের বিচার ব্যবস্থা যে কাঠামোতে দাঁড়িয়ে আছে তাতে খুব বেশি মানুষের বিচার করা সম্ভব নয় । কিন্ত যে কটা বিচার হয় তার কয়টাকে সুবিচার বলা যাবে?
কে না জানে যে টিআইবি প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে পুলিশ বিভাগের চেয়েও বিচার বিভাগে বেশি দূর্ণীতি হয় । এটা নিয়ে বেশ সমালোচনার ঝড়ও উঠেছিল । এ নিয়ে বিচার বিভাগ আর টিআইবির মধ্যকার বহসের কথা সংবাদপত্রগুলোও বেশ ঘটা করে ছাপছিল । কিছুদিন পড়ে শুনলাম প্রধান বিচারপতি চায়ের আমন্ত্রন জানালেন টিআইবির বসদের । তারপরেই সব বন্ধ । পরে কি হলো আর জানতে পারলাম না । আমাদের সর্বোচ্চ আদালত এ অভিযোগ খন্ডন করতে পেরেছে বলে শুনিনি । বা টিআইবি’র কেউ এ জন্য কোনো শাস্তি ভোগ করেছেন বলেও শুনিনি ।
আবার এই কোর্টের অবমাননার দায়েই আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক জেলও খাটলেন । রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাকে নির্যাতন করারও অভিযোগ রয়েছে । কারণ তার পত্রিকায় একটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল “চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে” এই শিরোণামে । অথচ তার কিছুদিন পরেই প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক এক অনুষ্ঠানে বলেছেন আমাদের বিচার বিভাগকে হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটার মতো স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে । প্রধাণমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিকুল হকও ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন । বিচার বিভাগের হাত পা বাধাঁর মানে কি? আর এ কাজ করার ক্ষমতা সরকার ছাড়া কার আছে? তাহলে আমাদের দেশের সম্পাদকের ভুলটা কি?
যে বিচার ব্যবস্থার হাত পা বেধেঁ পানিতে ফেলে দেয়া হয়েছে তা কি এখনও জীবিত আছে? আর যদি নাই থাকে তবে বিচারের দাবিতে আন্দোলন করে কি লাভ?

Somewhereinblog এ পড়েছি নরপশু হাসান সাইদ বন ও পরিবেশ মন্ত্রী হাসান মাহমুদের ভাতিজা । সেই ক্ষমতা ব্যাবহার করেই হাসপাতালে শয্যাশায়ী রুমানাকে গুলী করে অথবা এসিডে ঝলসে হত্যার হুমকিও দিয়ে যাচ্ছিল সে । জানাজানি হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হাসান সাইদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন, সমাবেশ ও মৌন মিছিল করে । হাসানকে গ্রেপ্তারের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি । লাভ হয়নি । কারণ আসামী পলাতক । পুলিশ খুঁজে পাচ্ছিলনা তাকে ।
নাটক শুরু হয় ১৫ই জুন । ঐ দিন সকালে হাসানকে কেন গ্রেপ্তার করা হয়নি তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট । আর তার কয়েক ঘন্টা পরেই হাসান গ্রেফতার! পরদিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে রিমান্ডেও নেয়া হয় । এতেই ছাত্র, শিক্ষক, আদালত--সবাই মোটামুটি ঠান্ডা ।
গ্রেফতার হবার কয়েক ঘন্টা পরেই টেলিভিশনে হাসানের লম্বা বক্তৃতা দেখানো হল । বক্তৃতা দেখেই মনে হচ্ছিল মিডিয়ার সামনে আসার আগে গোয়েন্দাদের কাছ থেকে লম্বা প্রশিক্ষণ নিয়েছে সে । শিখে এসেছে কিভাবে একজন শিক্ষকের নামে অপবাদ দিয়ে ক্ষমতাসীনদের মান আর নিজের জান রক্ষা করা যায় । রুমানা নাকি কার সাথে পরকিয়ায় লিপ্ত ছিলেন! আর হাসান তার বিরোধিতা করায় তাকে হত্যা করার জন্য রুমানা তাকে ১০০ ঘুমের বড়ি খাইয়েছিলেন! এ গল্প পত্রিকাগুলোও বেশ ঘটা করে ছেপেছে । প্রশ্ন হলো ১০০ বড়ি খাওয়ার পরও হাসান বেঁচে ছিলেন এবং শশুর শাশুড়ীকে বেধে রেখে রুমানাকে এভাবে নির্যাতন করার শক্তি ছিল তার গায়ে!! বাংলা সিনেমায়ও এত শক্তিধর নায়ক দেখা যায় না ।
তবে তার গোয়েন্দা প্রশিক্ষণ যে সফল হয়েছে সেটা ঠিক । ১৫ই জুন সন্ধ্যায় অনেককেই বলতে শুনেছি ‘আসল কাহিনি তাহলে এই? লোকটার একার দোষ দিয়ে লাভ কি?’ আরও কত কি!!
২
দু’বছর পুরো হয়নি আমার সহপাঠী সুতপাকে হত্যা করা হয়েছে । সুতপার আসল নাম মাফরুদা হক । হত্যা করার পর ওর শশুর বাড়ির লোকজন একে আত্নহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেও ময়না তদন্তের পরপরই পুলিশ আমাদের জানায় সুতপাকে হত্যা করা হয়েছে ।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ সহ আরো বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী এই ঘটনার প্রতিবাদ করল...ঘাতক ইমরুল সাদাত আবীর এর শাস্তি দাবি করল । ক্যাম্পাসে মানব বন্ধন হলো, সমাবেশ হলো । ঘাতককে গ্রেফতারও করা হলো, রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল । আমরাও বিচার পেয়ে গেছি ভেবে চুপ হয়ে গেলাম । সুতপাকে ভুলে যেতে শুরু করলাম ।
হঠাৎ একদিন শুনলাম সুতপা হত্যা মামলায় চার্জশিট দেয়া হয়েছে । চার্জশিটে বলা হয়েছে সুতপা আত্নহত্যা করেছে । খুনী ইমরুল সাদাত তাহলে নিরপরাধ!!
৩
সুতপা আর রুমানাদের কথা অনেকেই জানেন কারণ ওরা এ দেশের সর্ববৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী...শিক্ষক । ওদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদ হয় । নির্যাতন কারীরা গ্রেফতার হয় । রিমান্ডে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ হয় । জিজ্ঞাসাবাদকালে তারা অপরাধের কথা স্বীকার করে এবং......পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে ছাড়াও পেয়ে যায় ।
কিন্ত প্রতিদিন দেশের আনাচে কানাচে যত নারী নির্যাতিত হয়, যত মানুষ খুন হয় তার কত শতাংশ খবরের কাগজে ছাপা হয়? কয়টা ঘটনার প্রতিবাদ হয়? কয়টা ঘটনায় মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিবৃতি দেয়? কয়জন অপরাধী গ্রেফতার হয়? আর বিচার? সেতো সুতপা রুমানারাই পান না যাদের জন্য শিক্ষক শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমে আন্দোলন করেন, বুদ্ধিজীবিরা পত্রিকায় কলাম লিখেন, মন্ত্রী এমপিরা দুঃখ প্রকাশ করেন এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিবৃতি দেয় ।
এমন কোনো সপ্তাহ নাই যে সপ্তাহে দু’এক হালি হত্যাকান্ডের খবর পত্রিকায় আসেনা । কোনো ঘটনার সঠিক তদন্ত হয়েছে, কোনো অপরাধীর বিচার হয়েছে তা খুব একটা শোনা যায় না । দূর্ণীতি, লুট পাট, জমি দখল, বাড়ি দখল, খাল দখল, বিল দখল, নদী দখল, সরকারি প্রকল্পের টাকা চুরি, গম চুরি, চাল চুরির খবরতো পত্রিকায় অপরাধীদের নাম সহ ছাপা হয় । কোনো ঘটনার বিচার হয়েছে শুনিনি ।
শুনেছি অনেকেই বিচার প্রতিবাদতো দুরের কথা, নির্যাতনের কথা আরেকজনকে বলার সাহস পর্যন্ত পায় না । থানায় গেলে পুলিশ মামলা নেয়না । আর মামলা করার সাহসই বা কয়জনের আছে । সাহস থাকলেও মামলা চালানোর সামর্থ্য কয়জনের আছে? সামর্থ্য থাকলেও মামলা চালিয়েই কি লাভ? মামলার রায় কবে হবে তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? রায় হলেও তা কি আসামীর শাস্তি নিশ্চিত করতে পারে? লিমনের ঘটনায় দেখেছি আদালতের রায়ও তোয়াক্কা করেনা আইনশৃংখলা বাহিনী । আদালতের নির্দেশের পরেও Rab এর বিরুদ্ধে মামলা নেয় নি পুলিশ । গণমাধ্যমের জোর জবরদস্তির ফলেই অবশেষে লিমন কে জামিন দেয়া হয় । জামিনের পরেও তাকে আবার হাসপাতালে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় ।
একজন আইন ব্যাবসায়ী জানালেন দেশের সব নাগরিকের দায়ের করা মামলা চালানোর দায়িত্ব নাকি সরকারের। অর্থাৎ পুলিশ যে মামলা নথিভুক্ত করবে তা পরিচালনা করার দায়িত্ব সরকারের । নিম্ন আদালতের মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পাবলিক প্রসিকিউটরদের আর উচ্চ আদালতের মামলা পরিচালনার দায়িত্ব এটর্নি জেনারেলের অফিসের । দেশের কয়জন নাগরিক এই সেবা পান? পাবেন কি করে? এসব অফিসের কর্মকর্তাদের তো বড় বড় লোকের লুটপাট আর চুরির মামলা ডিফেন্ড করতে করতেই জান শেষ । আর সে জন্যই তো সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে এসব অফিসের ব্যাবসায়ীদের চেহারাও পাল্টে যায় । সরকারি এসব আইন অফিসের একজনকেও কি পাওয়া যাবে যারা ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে যুক্ত নন? যারা কখনো কোনো না কোনো ভাবে লুট পাট আর দখলের ভাগ পান নি?
৪
সাধারণ মানুষদের কথা বাদ । যারা অসাধারণ তারা কি বিচার পান? যেসব ঘটনায় পত্রিকাগুলো মাসের মাসের মাস সংবাদ ছাপে, যেসব ঘটনাকে পুজিঁ করে রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতি করে, হরতাল করে, গাড়ী পোড়ায়, পুলিশের সাথে মারামারি করে সেসব ঘটনার বিচার হয়?
গত পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনার ১০ বছর পুরা হল । ঐ বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হয়েছেন, ১১ জন পঙ্গু হয়েছেন । বিচার হয়নি । কেউ জানেন না আদৌ এর বিচার হবে কিনা । যদিও ঐ ঘটনাকে পুঁজি করে রাজনীতির মঞ্চ কাঁপিয়েছেন অনেকেই । যশোরে উদিচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার বিচার হয়নি । বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যা করা হয়েছে । এমনকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর উপরও গ্রেনেড হামলা হয়েছিল । তারও বিচার হয়নি । শুধু রাজনীতি হয়েছে ।
গত বছরের অক্টোবর মাসে নাটোরের বরাইগ্রাম উপজেলার চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ বাবুকে দিনের আলোতে হাজার হাজার মানুষের সামনে খুন করল ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা । সব পত্রিকায় খুনের ছবি ছাপা হলো । টেলিভিশনগুলো ভিডিও প্রচার করলো । তদন্তকারীরাও নিশ্চিত করে বললো যে যুবলীগের কর্মীরাই বাবুকে হত্যা করেছে । সব কিছুকে উপেক্ষা করে অক্টোবরের ১৪ তারিখে আওয়ামীলীগের ‘আইনপ্রনেতা’ আব্দুল কুদ্দুস খুনীদের আশ্বস্থ করে বললেন দলের কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যাবস্থা নেয়া হবে না । তিনি প্রধান আসামী জাকিরের প্রশংসাও করলেন । এই ঘটনায় ১০ জনকে গ্রেফতার করা হলেও এ বছর মার্চের ১০ তারিখ সবাই জামিনে মুক্ত হয়ে যান । এই নিয়ে পরে আর কিছু শোনা যায় নি ।
২০০৭ সালের ২১ অক্টোবর বিকালে নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলার শরীফপুর গ্রামের আব্দুর রশীদকে লক্ষ্য করে এসিড ছুঁড়ে তারই গ্রামের ভিটু মিয়া ও তার সাঙ্গ পাঙ্গরা । থানায় মামলা হয় । ঐ মামলা চালাতে সহযোগীতা করত এসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন । এমনকি ভিকটিম এবং তার পরিবার যাতে মামলাটি নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যাবস্থা গ্রহন করার জন্য এসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মনিরা রহমান নিজে অপরাধ মামলা মনিটরিং সেল, স্বরাস্ট্র মন্ত্রনালয়কে চিঠি দেন । ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মামলার অভিযোগ পত্রও দাখিল করা হয় । কয়েক মাস আগে মামলাটিকে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা বলে ফেলে দেয়া হয়েছে । হুমকি ধামকির মুখে আব্দুর রশীদ মিডিয়াকে এই ঘটনা জানায়নি ।
৫
ক্ষমতাসীনরা একের পর এক অপরাধ করে যান এবং পারও পেয়ে যান । মজার ব্যাপার হলো তারা নিজেরাও যখন আক্রান্ত হন...সুবিচার পান না । বিরোধীদলের কথা বাদই দিলাম...গত দুই বছরে ক্ষমতাসীন দলের কত লোক নিহত হয়েছে হিসাব নাই । একটারও কি বিচার হয়েছে? রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য আন্তঃকোন্দল, স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে ঝগড়ার সূত্র ধরে একই দলের এক কর্মী খুন করেছে আরেক জনকে । খুনিরা শাস্তি পেয়েছে শুনিনি কখনো । শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক ছাত্র নিহত হয়েছে । কোনো হত্যার বিচার হয়নি । বিচারের আশা করা দুঃসাহসিকতা বৈকি? কয়েক মাস আগেইতো হাইকোর্টে এক বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে আইনজীবিদের ব্যাপক প্রতিবাদ দেখলাম । কারন ঐ বিচারপতি ছাত্র খুনের দায়ে অভিযুক্ত ছিলেন । এমনকি তার নিয়োগের সময়ও ঐ মামলা চলছিল ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু নিশ্চয়ই অন্য মৃত্যুগুলোর মতো নয় । বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের প্রায় সব সদস্য খুন হলেন দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র কয়েক বছরের মাথায় । হত্যাকারীরা গণমাধ্যমে তাদের অপকর্মের কথা স্বীকারও করল । তবুও বিচার হলো না । আমাদের বিচার ব্যাবস্থা হত্যাকারীদের একাংশের শাস্তি নিশ্চিত করতে পেরেছে ৩৮ বছর পর ।
বঙ্গবন্ধু খুন হবার কয়েক মাস পরেই খুন হলেন স্বাধীনতার আরও চার নায়ক । অস্থায়ী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট, স্বরাস্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী খুন হলেন জেল খানায় । জেল খানার কয়েদীদের হত্যা করার ক্ষমতা কাদের রয়েছে তা সবারই জানা । কিন্ত এই চার নেতার হত্যাকারীদের বিচার এখনো হয়নি ।
মুক্তিযুদ্ধের একটা গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের অধিনায়ক এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান খুন হলেন । নামে একটা বিচার হয়েছে তার সমর্থকদের থামিয়ে রাখার জন্য । এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের আরও বহু বীর নিহত হয়েছেন । বিচার হয়নি কোনো হত্যার।
গত কয়েক বছরে মন্ত্রী থেকে শুরু করে তার নিচের পর্যায়ের কত নেতা খুন হয়েছেন । বিচার হয়নি । সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া, আওয়ামী লীগ নেতা আইভি রহমান, আহসানুল্লাহ সহ আরো বিভিন্ন দলের বহু নেতা খুন হয়েছেন । বিচার হয়নি ।
৬
দেশে অপরাধ যত বেশি, পুলিশ আর আইন ব্যাবসায়ীরা তত খুশী । মামলার বিচার হয়না অথচ হাজার হাজার আইন ব্যাবসায়ী কোটিপতি হয়েছেন এই মামলাগুলোকে পুঁজি করে । ডেইলি স্টার পত্রিকার সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১০ এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে পেশাদার আইনজীবিদের সংখ্যা হলো ৪১ হাজার । এদের মধ্যে ৫ হাজার জন নারী আইনজীবি রয়েছেন ।
এই মার্চের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল ২,৩০২ জন । এরাই দেশের সর্বোচ্চ আইনজীবি । নিম্ন আদালতের রায় চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতের রায় পরিবর্তন করেন এরা । তবে সাধারণ মানুষের পক্ষে এদের পোষা সম্ভব না । এক মামলার বাদী জানিয়েছেন একটা রিট পিটিশন দায়ের করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবি তার কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়েছেন । এক লাখ টাকা গচ্ছা দিয়ে ঐ লোক আর কোনোদিন আদালতে আসেন নি । নিজের চিকিৎসা করার পয়সা নাই আইনব্যাবসায়ীরে দিবেন কোথা থেকে? অনেক বিচারপ্রার্থী তাদের সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে এই আইন ব্যাবসায়ীদের ফি পরিশোধ করেন ।
আদালতের খরচও কি কম? আদালতের ফি কতজন মানুষ দিতে সক্ষম? ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৬ তারিখে হাইকোর্টের একটি রুলের কথা মনে পড়ে । বিচারপতি মোঃ ইমান আলী এবং বিচারপতি মোঃ আবু তারিক সরকারের প্রতি একটা রুল জারি করেছিল । ঐ রুলে সরকারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল সরকার যে উচ্চ আদালতের ফি বাড়িয়েছিল তা কেনো অবৈধ ঘোষণা করা হবেনা ।
১৯৮৮ সালের আপিল বিভাগ রুল হালনাগাদ করে আপিল বিভাগের আদালত ফি কয়েকগুন বাড়ানো হয়েছিলো । যেমন আগের নিয়ম অনুযায়ী, যেকোনো মামলার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের সর্বোচ্চ আদালত ফি ছিল ৪,০০০ টাকা । সেটা বাড়িয়ে ১ লাখ করা হয়েছে । ন্যায় বিচার চাইতে গিয়ে আদালত ফি যদি দিতে হয় ১ লাখ টাকা, তাহলে কতজন ন্যায় বিচার চাইতে যাবেন?
হাইকোর্টের এক কর্মকর্তার কাছে শুনেছি আইনজীবিরা চান না কোনো মামলার চুড়ান্ত নিস্পত্তি হয়ে যাক । তারা এমন ভাবে মামলা পরিচালনা করেন যাতে রায় দীর্ঘায়িত হয় । তবে এ জন্য তাদের খুব খাটাখাটি করতে হয় না । এক মামলা একবার স্থগিত করা গেলেই সেটার আবার আদালতের শিডিউল পেতে বছর লেগে যায় ।
২০০৯ সালে যতজন হাইকোর্ট থেকে অন্তর্বতীকালিন জামিন নিয়েছেন, তাদের ৩,২০০ জনই জামিন নেয়ার পর আর কখনোই আদালতে হাজিরা দেননি । তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিবে কে? (ডেইলি স্টার জানুয়ারি ১২, ২০১১)
৭
২০১১ সালের ২০ মার্চ আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ জাতীয় সংসদে বলেছেন দেশের বিভিন্ন আদালতে বর্তমানে ১৯ লাখ ৪২ হাজার ১৮৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে । যার মধ্যে ৯ হাজার ১৪১ টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে আপিল বিভাগে । আর ৩ লাখ ১৩ হাজার ৭ শত ৩৫ টি রয়েছে হাইকোর্টে ।
নয় হাজারের বেশি মামলার বিচারের জন্য আপিল বিভাগে মোট বিচারক রয়েছেন প্রধান বিচারপতি সহ আট জন । আর ৩ লাখ ১৩ হাজার ৭ শত ৩৫ টি মামলার বিচারের জন্য হাইকোর্টে বিচারক রয়েছেন ৯০ জন (সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইট, ১৬ ই এপ্রিল ২০১১) ।
দেশের চলমান বিচার ব্যবস্থায় যে কোনো মামলার চুড়ান্ত নিস্পত্তি হয় আপিল বিভাগের মাধ্যমে । যে কোনো মামলার প্রথম রায় হয় নিম্ন আদালতে । যদি কোনো এক পক্ষের ঐ রায় পছন্দ না হয় তাহলে তারা ঐ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করতে পারেন । দুই পক্ষের শুনানি শেষে হাইকোর্ট আবার রায় দেন । যদি এই রায়ও কোনো এক পক্ষের পছন্দ না হয় তা হলে তারা আপিল বিভাগে আবেদন করতে পারেন । এবং আপিল বিভাগের এই রায়ও চুড়ান্ত রায় নয় । আপিল বিভাগ রায় প্রদান করার পরও কেউ চাইলে ঐ রায় রিভিউ করার আবেদন করতে পারেন । অর্থাৎ ১৬ কোটি মানুষের বিচারের ভার মূলত আটজন বিচারকের উপর ।
কথা হলো এই আটজন মানুষ দৈনিক কয়টি রায় প্রদান করতে পারেন? ছুটি ছাটা বাদ দিয়ে তারা বছরে কয় দিন আর কাজ করতে পারেন । হাইকোর্টের একজন আইনজীবি বলেছেন আপিল বিভাগের বিচারকদের বেশির ভাগ সময় কাটে বড় বড় ঘটনার বিচার কার্যক্রমে । এমনও অনেক সময় যায় যখন টানা কয়েক সপ্তাহেও সুপ্রিমকোর্ট একটি মামলার রায় দিতে পারেন না । যেমন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সময় টানা বহু দিন আপিল বিভাগ আর কোনো মামলার কার্যক্রম চালাতে পারেন নি । একই ভাবে সংবিধান সংশোধন মামলা, স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে মামলা, সংবিধান পূনঃমূদ্রন মামলা, আমার দেশ সম্পাদক এর বিরুদ্ধে মানহানি মামলার শুনানির সময় আদালত আর কোনো মামলার শুনানি হয়নি । মাসে আসলে দু’এক ডজনের বেশি মামলা কোনো ভাবেই নিস্পত্তি সম্ভব নয় । সুতরাং বিচারাধীন ২০ লাখ মামলার বিচার অদৌ সম্ভব নয় ।
২০১০ এর অক্টোবর মাসে হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৫৩ হাজার । প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেয়া বিশেষ পদক্ষেপের ফলে ২০১০ এর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে এই সংখ্যা ৩ লাখ ১৩ হাজারে নেমে আসে । অনেকেই অবাক হতে পারেন এই ভেবে যে তিন মাসে ৪০,০০০ মামলা কিভাবে নিস্পত্তি হলো ! আসলে এই মামলাগুলোর নিস্পত্তি সম্ভব হয় নি । এগুলোর আর বিচার হবেনা । এর আসামীরা পার পেয়ে গেলেন ।
তখনকার প্রধান বিচারপতি দেখলেন সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দিষ্ট সেকশনে ৪০,০০০ মামলা দায়ের হয়েছে যেগুলো কোনো বেঞ্চই শুনেনি । ফলে নভেম্বরে এই মামলাগুলো হাইকোর্টের ‘বিচারাধীন তালিকা’ থেকে ফেলে দেয়া হয়েছে ।
নাম প্রকাশ না করে সুপ্রিম কোর্টের এক কর্মকর্তা বলেছেন বিচারাধীন মামলাগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সময় তারা ৩৯ টি জামিন আবেদন পেয়েছেন যেগুলো ১৯৯৬ সালে দাখিল করা হয়েছিল । ঐ আবেদনগুলো ২০১১ সাল পর্যন্ত শুনা হয়নি ।
তবে আদালতের খরচ আর আইন ব্যাবসায়ীদের ফি দেয়ার ক্ষমতা যার নাই হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্টের ঝামেলাও তার নাই । শুধু চুপচাপ সবকিছু সহ্য করতে পারার ক্ষমতা অর্জন করতে পারলেই হলো । কোনোভাবেই আদালতের সমালোচনা করা যাবে না । আদালত অবমাননা মামলা ভয়ংকর মামলা । এসব মামলার নিস্পত্তি হয় খুব তাড়াতাড়ি ।
৮
ষোল কোটি মানুষের বাংলাদেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষই দিনে দুই বেলা খাবার যোগাড় করতে পারেন না । এসব পরিবারের দৈনিক আয় ৯০ টাকারও কম । প্রতিদিন নানান অন্যায়, অত্যাচার আর অবিচারের শিকার হন এরা । সুবিচারের প্রয়োজন এরাই সবচেয়ে বেশি অনুভব করেন কিন্ত ‘বিচার ব্যবস্থা’ নামক সাদা হাতির ধারে কাছেও তারা পৌছাতে পারেন না । অবশেষে নালিশ করেন আল্লাহর কাছে ।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী বাকি সাড়ে আট কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র আট লাখ মানুষ খেয়ে পড়ে অন্যান্য কাজে টাকা খরচ করার ক্ষমতা রাখেন ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী এই আট লাখ মানুষ প্রতিদিন ৪৫০ টাকার বেশি আয় করেন । বছরে এদের আয় ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকার বেশি । এরা করদাতা, প্রথম শ্রেনীর নাগরিক ।
এছাড়াও আরো ১৪ লাখ মানুষ আছেন যাদের বাৎসরিক আয় মাঝে মাঝে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা অতিক্রম করে । অর্থাৎ এদের ট্যাক্স পরিচয় নাম্বার আছে কিন্ত প্রতি বছর ট্যাক্স দেয়ার মত টাকা আয় করতে পারেন না ।
বাকি আট কোটিরও বেশি মানুষের পরিবারের দৈনিক আয় ৪৫০ টাকার কম । যে টাকা দিয়ে কোনো রকমে থাকা, খাওয়া, পোশাক আশাক, ছোটো খাটো রোগের চিকিৎসা সম্ভব । অন্যায় নির্যাতনের শিকার হলেও বিচারের জন্য ব্যয়বহুল আইনের দোকানে যাওয়ার ক্ষমতা এদের অনেকেরই নাই । ঝগড়া ফাসাদ, কোর্ট কাচারি তাই যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলেন এদের অনেকেই ।
সরকারী হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের যে ২২ লাখ ধনী মানুষ রয়েছেন তারা বিচার ব্যবস্থার সুফলতা কতটা ভোগ করছেন? এই ২২ লাখের একটা বড় অংশ সব সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত থাকেন । বিরোধী দলের জন্য সুবিচার প্রত্যাশা করা ধৃষ্টতা বৈকি । এ ছাড়াও বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর সদস্যরাও বিচার ব্যবস্থার সুফল পান না ।
বাকি থাকে থাকে সরকার দলীয় নেতা কর্মী, আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্য, সরকারী কর্মকর্তা, আইনজীবি এবং বিচারকদের পরিবারের সদস্য এবং ব্যাবসায়ীরা । পুলিশ, সরকারি দফতর এমনকি বিচারকদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাব সুস্পষ্ট । সুতরাং সরকারের বিরাগভাজন কর্মকর্তা কর্মচারীরাও অবিচারের শিকার হন । কিন্ত বিচারের জন্য আদালতে গিয়ে খুব একটা ফল হয় না ।
৯
আমাদের বিচার ব্যবস্থা যে কাঠামোতে দাঁড়িয়ে আছে তাতে খুব বেশি মানুষের বিচার করা সম্ভব নয় । কিন্ত যে কটা বিচার হয় তার কয়টাকে সুবিচার বলা যাবে?
কে না জানে যে টিআইবি প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে পুলিশ বিভাগের চেয়েও বিচার বিভাগে বেশি দূর্ণীতি হয় । এটা নিয়ে বেশ সমালোচনার ঝড়ও উঠেছিল । এ নিয়ে বিচার বিভাগ আর টিআইবির মধ্যকার বহসের কথা সংবাদপত্রগুলোও বেশ ঘটা করে ছাপছিল । কিছুদিন পড়ে শুনলাম প্রধান বিচারপতি চায়ের আমন্ত্রন জানালেন টিআইবির বসদের । তারপরেই সব বন্ধ । পরে কি হলো আর জানতে পারলাম না । আমাদের সর্বোচ্চ আদালত এ অভিযোগ খন্ডন করতে পেরেছে বলে শুনিনি । বা টিআইবি’র কেউ এ জন্য কোনো শাস্তি ভোগ করেছেন বলেও শুনিনি ।
আবার এই কোর্টের অবমাননার দায়েই আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক জেলও খাটলেন । রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাকে নির্যাতন করারও অভিযোগ রয়েছে । কারণ তার পত্রিকায় একটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল “চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে” এই শিরোণামে । অথচ তার কিছুদিন পরেই প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক এক অনুষ্ঠানে বলেছেন আমাদের বিচার বিভাগকে হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটার মতো স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে । প্রধাণমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিকুল হকও ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন । বিচার বিভাগের হাত পা বাধাঁর মানে কি? আর এ কাজ করার ক্ষমতা সরকার ছাড়া কার আছে? তাহলে আমাদের দেশের সম্পাদকের ভুলটা কি?
যে বিচার ব্যবস্থার হাত পা বেধেঁ পানিতে ফেলে দেয়া হয়েছে তা কি এখনও জীবিত আছে? আর যদি নাই থাকে তবে বিচারের দাবিতে আন্দোলন করে কি লাভ?
2 comments:
অসাধারণ একটি ভাল পোস্ট হয়েছে।অনেক কিছু জানলাম এখান থেকে। তবে আমাদের বিচার ব্যবস্থার অবস্থা যে এতটা শোচনীয় তা আগে ভাবতে পারিনি। তাহলে আমাদের দাড়াবার জায়গাটা কোথায়? আমার জানা নেই। কোথায় গিয়ে যে আবার আমরা সামনের দিকে হাটা শুরু করবো? ধন্যবাদ ইউসুফকে এমন একটি পরিশ্রমী লেখা দেয়ার জন্য।
১৮ জুন, ২০১১ এ ৯:৪৪ PMদাদা, সবকিছু আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে । আর যেসব তথ্য এখানে দেয়া হয়েছে সেগুলো গোপন কোনো সুত্র থেকে নেয়া তথ্য নয় । একটু ঘাটাঘাটি করলেই পাওয়া যায় । এসব তথ্য আপনার চোখে এর আগে পরেনি সেটা আমি মানতে নারাজ । সবগুলোকে একত্রিত করে কেউ উপস্থাপন করেনি বলেই হয়তো আমরা আসল চিত্রটা বুঝতে পারিনি ।
১৮ জুন, ২০১১ এ ৯:৫৩ PMএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন