
একবার ভাবলাম বিশ্বকাপটা বাংলাদেশই জিতে ফেলেনিতো ! পরক্ষণেই মনে পড়ল আরে আমাদের সোনার ছেলেরা তো সেই প্রথম পর্বেই বিদায় নিয়েছে । তাহলে আবার কি হল ! আমাদের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী বিদেশ থেকে কোন পুরস্কার টুরস্কার নিয়ে আসেননিতো? বেশ কিছুদিন আগে ভারত থেকে ফেরার পর ভয়াবহ এক রিসেপশান দেয়া হয়েছিল তাকে । নাহ! আজকে মনে হয় উনি আসেননি । সকালেই তো দেখলাম কোথায় যেন ভাষণ দিচ্ছেন ।
তাহলে? নতুন করে আবার কেউ নোবেল পুরস্কার পাননিতো! মনে হয় না । আর, পেলেই কি ! ওসব পুরস্কারের কোনো দাম আছে নাকি এ দেশে যেটা আমাদের প্রধানমন্ত্রীই এখনো পান নি । ডক্টর ইউনুস তো নোবেল পেয়েছিলেন কিন্ত তিনি এমন কোনো রিসেপশান পেয়েছিলেন বলেতো শুনিনি ।
হঠাৎ কারো মুখে গালি শুনে আমার চিন্তায় বিঘ্ন ঘটল । "এই দুইডারে চৌরাস্তায় ফেইল্লা গুল্লি কইরা মারন উচিত । এগর মরণ না হইলে এই জীবনে আর শান্তি আইবনা ।" বুঝলাম 'ঐ দুইজনের' বাকি একজনই কিছু একটা সাধন করেছেন আজ । জানতে পারলাম তিনি কিছু জিতেন নি । কা'বা শরীফে গিয়ে দেশের মানুষের জন্য কল্যাণ কামনা করে দেশে ফিরেছেন ।
কয়েকবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি । বেঁচে থাকলে হয়ত আবার হবেন । মাঝে মাঝেই ওমরাহ্ করতে চলে যান সউদি আরব । এবার ওমরাহ্ করে ফিরলেন ১৩ দিন পর । তাকে এক নজর দেখার জন্য হাজার হাজার মানুষ তাই বিমান বন্দরে গিয়ে বসে আছে । দুই সপ্তাহ তাকে দেখেনি !
এত্তো মানুষ যাকে ভালোবাসেন আমাদের মতো নগন্য মানুষদের কথা ভাবার তার সময় কই !
২
মাঝে মাঝে নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয় । আজও একবার মনে হলো । মনটা বেশ খারাপ হলো আবার । আমার পড়াশোনা, চিন্তা ভাবনা, স্বপ্ন, কাজ কর্মের এ দেশে কোনো দাম নেই জানি । সময়ের দাম তো আশা করারই সাহস পাইনি । তাই বলে কোনো রকমে একটু বেঁচেও থাকতে পারবো না? অফিসে পৌছলাম এক ঘন্টা দেরিতে । বস চাইলে বকা দিতে পারতেন । বকেন নি । বেতন কাটবেন হয়তো ।
আমার দেড় ঘন্টা পরে দুই নেত্রীকে গালি দিতে দিতে অফিসে ঢুকলেন মাকসুদ ভাই । মার্কিন দুতাবাসের সামনে থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গেইট পর্যন্ত আসতে বেচারার দুই ঘন্টা সময় লেগেছে । তীব্র যানজটের মধ্যে একবার রাস্তার মধ্যে গাড়ি রেখে চা সিগারেটও খেয়ে এসেছেন । এই রাস্তায় গাড়ি চুরি করবে সে সাহস কার? তাহলে গাড়িতে পাখা লাগাতে হবে যে ।আড়াই ঘন্টা পরে হলেও অফিসে পৌছতে পেরেছেন তাতেই আপাতত খুশি তিনি ।
মাকসুদ ভাই আসার পর জাহাঙ্গীর ভাই, শাহীন ভাই, আমিনুল ভাই আর মুকিত ভাই মিলে ক্যান্টিনে চলে গেলাম । সবাই মিলে দুই নেত্রীর গোষ্ঠী উদ্ধার করলাম । মনটা একটু ভালো হলো । ঘরে নিজেদের ক্ষমতা দেখে ভালই লাগলো ।
রাতে জানতে পারলাম আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অর্থাৎ খালেদা জিয়ার রিসেপশনের কারণে সাড়ে চার ঘন্টা বন্ধ ছিল এয়ারপোর্ট সড়ক । বনানি থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ছিল বিএনপি নেতা কর্মীদের দখলে ।
পরদিন মনটা আবার খারাপ হলো । কারণ আমি যে দুটি পত্রিকা বাসায় রাখি তার একটাতেও আমাদের কষ্টের এক লাইন বর্ণনা নাই । জানি মন খারাপ করাটা উচিত হয়নি, কারণ এমন ঘটনা এদেশে প্রায়ই ঘটে । তবুও মন খারাপ হলো । তবে আমার পত্রিকা 'ডেইলি সান' এ অবশ্য সংবাদটা ছাপা হলো প্রথম পাতায়।
৩
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসের ১৯ তারিখে নিউইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের ৬৫তম সাধারণ অধিবেশন শেষে দেশে ফিরবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । তাকে অভ্যর্থনা দেয়ার জন্য রাতের বেলা রাস্তা বন্ধ করে প্লাকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুন হাতে রাস্তায় দাড়িয়ে আছে হাজার হাজার নেতা-কর্মী । আর লাখ লাখ সাধারণ মানুষ রাস্তায় বসে ট্রাফিক সিগনাল দেখছে । পুলিশের কিছু করার নাই ।
সাংবাদিকেরা এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ নেতা মাহাবুবুল আলম হানিফ উল্টো নেতা কর্মীদের ভূয়সী প্রশংসা করলেন ।
গত বছর ভারত থেকে ফেরার সময় হাসিনাকে দেয়া সম্বর্ধনার কথা ঢাকার রাস্তায় যারা চলাফেরা করেন তাদের বহু দিন মনে থাকার কথা । ২০০৮ সালের ৬ই নভেম্বর অর্থাৎ কেয়ারটেকার সরকারের সময়েও হাসিনাকে এরকম এক সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল ।
ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ঢাকা শহরের যানজট নিরসনের জন্য অনেক রকমের পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলে থাকেন হাসিনা খালেদা দুজনই । কখনো বাস টার্মিনালগুলো স্থানান্তরের কথা বলেন, কখনো বলেন ই-টিকেটিং চালু করবেন, কখনো বলেন পার্কিং নীতি করবেন । মেট্রো রেইল আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের আওয়াজতো এখন গণমাধ্যমে বেশ শোনা যাচ্ছে ।
তবে ওনাদের যাতায়াতের কারণেও যে জনগণের প্রচুর দুর্ভোগ হচ্ছে তা নিয়ে উনারা কখনো কিছু বলেছে বলে শুনিনি । আমার এক সহকর্মী এক সময় ফরেন সার্ভিসে ছিলেন । চাকরির সুবাধে বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন । ওনার কাছে শুনলাম ইউরোপ আমেরিকায় নাকি প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর যাতায়াতের জন্য রাস্তা বন্ধ করা হয়না । অবশ্য, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীরাতো তাদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ !
এই ফেব্রুয়ারি মাসের ১০ তারিখের খবর । রোবার স্কাউটের ক্যাম্প উদ্বোধন করতে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে যাবেন প্রধানমন্ত্রী, সে জন্য ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক দুই ঘন্টা বন্ধ । রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে দুপুর ১২ টায় আর প্রধানমন্ত্রীর গাড়ী বহর গেছে ২টায় । দুপুরের কড়া রোদে রাস্তায় পুড়ছে হাজার হাজার গাড়ী আর তার যাত্রীরা । মানুষের দুর্ভোগের কথা নাই বললাম । প্রধানমন্ত্রী কোথাও যাচ্ছেন তাই রাস্তা ঘাট বন্ধ ঢাকা শহরে এমন দৃশ্য প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায় ।
৪
বুয়েটের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, পিক আওয়ারে ঢাকার রাস্তায় প্রতি ঘন্টায় ১২,৫০০ গাড়ী চলাচল করে ।
২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত চার বছর সময়ে প্রায় ৮৪,০০০ প্রাইভেট কারের রেজিস্ট্রেশন করেছে বিআরটিএ । এই সময়ে ঢাকার রাস্তায় পাবলিক বাস নেমেছে মাত্র ৪৮৩২ ।
বিদেশিরা আমাদের দেশে ব্যাবসা করতে চায়না এই যানজটের কারণে ।
ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক এস এম সালেহ উদ্দিন ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে এক সেমিনারে বলেছিলেন যানজটের কারণে শুধু ঢাকা শহরে ১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ প্রায় ১২,০০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয় । আমাদের সময়ের দাম, মানুষের জীবনের দাম আর পরিবেশের যে ক্ষতি হয় সে হিসাব না হয় নাই করলাম ।
যানজট নিয়ে বড় অফিসারদের জিজ্ঞেস করলে কখনোই ‘ভিআইপি’দের যাতায়াত কারণ হিসেবে আসেনা । তবে বিভিন্ন সভা সেমিনারে অনেক কারণ নিয়ে আলোচনা হয় । যেমন সুয়ারেজ লাইন মেরামত, ত্রুটিপূর্ণ ব্যাবস্থাপনা, দুর্বল অবকাঠামো, ফুটপাথ দখল এবং ট্রাফিক পুলিশদের দুর্ণীতি । সবচেয়ে বড় কারণ আইনের প্রতি আমাদের অশ্রদ্ধা ।
অবকাঠামো উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয় কিন্তু উন্নয়ন হয়না । শুনেছি এই টাকার একটা বড় অংশ পায় যারা প্রধানমন্ত্রীদের অভ্যর্থনা দিতে বিমান বন্দর যান । আবার করও ফাকি দেন ঐ অভ্যর্থনা প্রদানকারিরাই । আর আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা? সেটা কারা করেন? মোটামুটি সবাই । শ্রদ্ধা আসবে কোত্থেকে? আইন ও তো বানান ঐ অভ্যর্থনা প্রদানকারিরাই । রাস্তা ঘাটে আইন ভেঙ্গে রাস্তা অবরোধ আর গাড়ী ভাংচুর করার রেকর্ড ও তাদেরই বেশি ।
৫
ক্যান্টিনে কথা বলতে বলতে এক সময় শাহীন ভাই জিজ্ঞেস করলেন ‘এ সমস্যার সমাধান কি?’
আসলেইতো ! এ সমস্যার সমাধান কি? এ প্রশ্ন আমার, জাহাঙ্গীর ভাই, শাহীন ভাই, আমিনুল ভাই আর মুকিত ভাই--- সবার ।
ওরা আসলে সংখায় কয়জন? আমরা যারা এর শেষ চাই তাদের চেয়ে নিশ্চয় বেশি নয় । এদের কবল থেকে কি আমরা কখনোই মুক্তি পাবনা? বর্তমান সরকারের আগে তো একটা সরকার দেশ প্রায় দুই বছর চালিয়েছিল । তাদের ও তো মানুষ মেনে নেয়নি । ভোট দিয়ে আবার এদেরই নিয়ে এসেছি সংসদে ।
আসলে আমাদের সবার মনেরই কোথাও কোথাও না কোথাও খালেদা হাসিনা বাস করছে । আমাদের সব কিছুর দায়িত্ব যেন আমরা ওনাদের দিয়ে দিয়েছি ।
ডেইলি সানের সিনিয়র সহ-সম্পাদক মাকসুদ ইবনা রহমান বললেন “Just start saying ‘no’ to these two persons and their parties” । মাকসুদ ভায়ের ধারণা সবাই মিলে এই দুই দলকে বর্জন করতে পারলে স্বাভাবিক ভাবেই নতুন নেতৃত্ব আসবে এবং রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে ।
তবে আমার আরেক সহকর্মী ফরহাদুল ইসলামের মতামতটা আরও বেশি বাস্তব সম্মত মনে হচ্ছে । উনি বিশ্বাস করেন না যে সবাই আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি কে বর্জন করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে । এ দেশের ইতিহাস এই বক্তব্য সমর্থন করে না ।
তার মতে, নেতারাই দেশের মানুষের প্রতিচ্ছবি ।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ফরহাদ ভাইয়ের মতে একটা দেশের সাধারণ মানুষরা নাকি তাদের নেতাদের মতই । অর্থাৎ হাসিনা-খালেদা আমাদেরই এক প্রতিচ্ছবি । আর আমরা আমাদের নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখেই বিরক্ত হই, ঘৃনা লাগে, কষ্ট পাই ।
আমার আরেক সহকর্মী ফরহাদ ভাইয়ের কথাটা আরো সহজ করে দিলেন । তিনি বললেন, আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের নেতা নেত্রীদের যেসব কর্মকান্ডের সমালোচনা করি, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমরা সবাই ঐসব কাজ করি । সুতরাং এই অবস্থার পরিবর্তন চাইলে আমাদের নিজেদেরকে সচেতন এবং সজাগ হতে হবে ।
মাকসুদ ভাই বললেন, "মাছের মাথা পঁচে আগে, তারপর বাকী অংশ ।" আমাদের দেশের মাথা ইতোমধ্যে পঁচে গেছে । সুতরাং দেশটাকে বাঁচাতে হলে লেজ আর বাকি দেহকে যেকোনো মূল্যে বাঁচাতে হবে ।
4 comments:
তোমার লেখাটি বেশ ভালো হয়েছে। আমারও ঐ দিনের কথা মনে পড়ছে।
৬ এপ্রিল, ২০১১ এ ৯:৫০ PMsundor vai... jodio traffic er kobole porina onekdin.. tobe jara poren ,tader kostota feel korte pari.
১১ এপ্রিল, ২০১১ এ ২:৪২ AMYour Bangla has improved incredibly..carry on...
১২ এপ্রিল, ২০১১ এ ২:৫৭ PMএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন